আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পৃথিবীতে মানব জাতিকে সৃষ্টি করে তাদের সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য সহি কিতাবসহ নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং নবী-রাসূলের আগমনের স্পষ্ট প্রমাণের জন্য তাঁদের মাধ্যমে কিছু কাজ সম্পন্ন করেছেন, যা কিয়ামত পর্যন্ত স্মৃতি বহন করে চলবে। তার মধ্যে বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর অন্যতম। এটিকে আল্লাহ নিজের ঘর হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। ‘ইত্তাখাযাল্লাহু বাইতান ফিদ্দুনিয়া’ এটি মুসলিম জাতির জন্য এক অপূর্ব নিয়ামত। অন্য ধর্মের কেউ ইচ্ছা করলে কুরআনের সাথে এসব নিদর্শন প্রমাণ করে মিলিয়ে দেখে তারপর শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্ম বুঝেশুনে জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে।
যারা বাপ-দাদার ধর্ম হিসেবে জন্মসূত্রে ইসলাম পেয়েছেন এবং যুগ যুগ ধরে মেনে চলছেন অথচ বাইতুল্লাহ দেখেননি, তারাও যদি বাইতুল্লাহ এক নজর দেখার সৌভাগ্য হয় তাহলে বুঝবেন আপনি প্রকৃতপক্ষেই শ্রেষ্ঠ ধর্মের একজন অনুসারী। আল্লাহ সূরা আল ইমরানের ৯৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন- ‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর, যা মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এই ঘর, যা বাক্কায় (মক্কা) অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হেদায়েত ও বরকতময়।’ এ ঘরটিকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য কুরআনের শুরুতে যেমন ‘লা-রাইবা’ শব্দ দিয়ে কোনো সন্দেহ নেই বলে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন, তেমনি এখানেও নিঃসন্দেহে শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
আরো স্মৃতি স্মরণীয় ও গুরুত্ব প্রমাণ করার জন্য আল্লাহ তায়ালা সূরা আল ইমরানের ৯৭ নম্বর আয়াতে বলেছেন- এতে রয়েছে মাকামে ইব্রাহিমের মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে লোক এর ভেতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর এ ঘরের হজ করা হলো মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য; যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যে লোক তা মানে না। আল্লাহ সারা বিশ্বের কোনো কিছুরই পরোয়া করেন না।
এ ছাড়াও কুরাইশ বংশের উদ্দেশে সূরা কুরাইশের ৩ ও ৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেÑ ‘অতএব তারা যেন ইবাদত করে এই ঘরের পালনকর্তার। যিনি তাদেরকে ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং ভীতি থেকে তাদেরকে নিরাপদ করেছেন।’ আরবি অক্ষর কাফ, আইন ও বা- এ তিনটি অক্ষর নিয়ে গঠিত হয়েছে কা’ব বা মুকাআ’ব শব্দ, যার অর্থ চার কোণবিশিষ্ট। যেহেতু কাবাগৃহ চার কোণবিশিষ্ট, সেহেতু এর নামকরণ এখানে এভাবেই এসেছে। অন্য আরেকটি ব্যাখ্যা অনুযায়ী, আরবিতে সুউচ্চ গৃহকে কাবা বলা হয়। কাবাঘর উঁচু বলে নামকরণ করা হয়েছে কাবা।
পবিত্র কুরআনের সূরা আল মায়েদার দুই জায়গায় এই পবিত্র গৃহকে কাবা নামে সম্বোধন করা হয়েছে। পবিত্র এই গৃহের আরো চারটি নাম রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- ১. আল বাইত, ২. বাইতুল আতিক, ৩. মসজিদুল হারাম ও ৪. বাইতুল মুহাররাম।
এ ঘরটিকে আমাদের জন্য ‘নিয়ামত’ বলছি এ জন্য যে, এ ঘরের সাথে স্মৃতিতে জড়িত প্রথম মানব এবং নবী হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা: পর্যন্ত দুই লাখ ২৪ হাজার পয়গম্বরের স্মৃতি এবং কিছু জান্নাতি বস্তু এখানে আল্লাহ নিদর্শন হিসেবে রেখেছেন। এ ছাড়া কিছু স্থানকে খাস করে দোয়া কবুলের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এই ঘর পৃথিবীর মধ্যখানে অবস্থিত। এই ঘর বরাবর ওপরে অবস্থিত বাইতুল মামুর। সেখানে প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশতা তাওয়াফ করেন। যারা একবার তাওয়াফ করেন, তারা কিয়ামত পর্যন্ত দ্বিতীয়বার সুযোগ পাবেন না; কিন্তু মানুষ ইচ্ছা করলে জীবনের প্রতিদিন কাবা তাওয়াফ করতে পারবেন।
এ ঘরকে কেন্দ্র করে এখানে আছে মহানবী মোহাম্মদ মোস্তফা সা:-এর নিজ হাতে বসানো হাজরে আসওয়াদ বা গুনাহ মাফের বেহেশতি পাথর। হাদিস শরিফের আলোকে এ পাথরের গুণ হলো, একটি চুম্বনে মুসলিমের গুনাহ মাপ হয়ে যায়, সুবহান আল্লাহ।
হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিম সম্পর্কে নবীজী সা: বলেছেন, নিশ্চয়ই হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিম জান্নাতের দু’টি অতি মূল্যবান ইয়াকুত পাথর। পৃথিবীতে প্রেরণের সময় মহান আল্লাহ তায়ালা এই পাথর দু’টির ঔজ্জ্বল্য ম্লান করে তারপর প্রেরণ করেছেন। তা না হলে এদের আলোতে সমস্ত পৃথিবী এমনভাবে আলোকিত হয়ে থাকত যে দিন-রাতের পার্থক্য বোঝা যেত না।
অন্য এক হাদিছে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে প্রেরণের সময় হাজরে আসওয়াদ দুধের মতো সাদা ছিল। কিন্তু মানুষের পাপের স্পর্শে সেটি কালো রঙ ধারণ করেছে।
হাজারে আসওয়াদ আর কা’বা শরিফের দরজার মাঝখানের জায়গাটির নাম ‘মুলতাজাম’ রাসূল সা: এখানে নিজের ডান গাল ও পেট লাগিয়ে দোয়া করতেন। দোয়া কবুলের আনন্দে তিনি কেঁদে দাড়ি ও বুক ভাসিয়ে ছিলেন। এরপর সাহাবাগণও বাইতুল্লাহর সাথে পেট লাগিয়ে দরজা ধরে দোয়া করতেন, দোয়া কবুল হতো। এর পাশেই রয়েছে ‘মুসল্লায়ে জিব্রাঈল’ আ:, এখানে জিব্রাঈল আ: নামাজ আদায় করেছিলেন। এখান থেকে বাইতুল্লাহ নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তার সাথেই রয়েছে মাকামে ইব্রাহীম আ:, যে বেহেস্তি পাথরে দাঁড়িয়ে তিনি কা’বা নির্মাণের কাজ করে ছিলেন। যেখানে এখনো তাঁর পায়ের ছাপ দেখা যায়। যা এখন গ্লাস বেষ্টন করে একটি পিলারে রাখা হয়েছে। তার পাশেই রয়েছে হাতিমে কা’বা। হাতিমে কা’বাকে কাবার অংশ ধরা হয়। যেখানে দু’রাকাত নামাজ পড়ার জন্য সবসময় ভিড় লেগে থাকে। সাফা মারওয়া পাহাড়দ্বয়, অলৌকিক ভাবে পাওয়া বেহেস্তি পানি জম জম কূপ এবং সাফা মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যখানে মিলাইনে আখজারাইন রয়েছে। সব স্মৃতি এ কা’বাকে ঘিরেই। এগুলোতে দোয়া কবুল হয়। কা’বার আশে পাশেই এসব অবস্থিত।
বাইতুল্লাহ প্রথম নির্মাণ করলেন ফেরেস্তারা, পরে হজরত আদম আ:, পরে নূহ আ:, তারপর ইব্রাহীম আ:, ইসমাইল আ: ও নির্মাণ করলেন। ইব্রাহীম আ: একজন নবী হয়ে ঝাড়ু দিলেন। ‘তহ্হেরা লিত্তয়েফিনা ওয়াল আকেফিনা রুক্কাড়িসসুজুদ ’ তারপর আল্লাহর নির্দেশে তিনি আজান দিলেন।
পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম আ: দুনিয়ার বুকে প্রেরিত হয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের একমাত্র নিদর্শন স্বরূপ এ কা’বা ঘরকেই পেয়েছিলেন। হজরত আদম আ: ও বিবি হাওয়া রা: পৃথিবীতে আগমনের পর আল্লাহ তায়ালা তাদের কাবা ঘর তাওয়াফের নির্দেশ দেন। হজরত আদম আ: হচ্ছেনÑ সর্ব প্রথম মানব যিনি কাবা ঘর তাওয়াফ করেন।
এ শহরে সৎ ও সত্যের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত। কাফের ও অত্যাচারী বা মিথ্যা সর্বদা লাঞ্ছিত। আপনি একজন সৌভাগ্যবান মুসলিম হিসেবে সব নবী-রাসূলের স্মৃতিবিজড়িত এই সর্বোত্তম পবিত্র স্থানটি সুনজরে দেখে আসুন। এ অছিলায়ও আল্লাহ মাফ করে দিতে পারেন।
লেখক: প্রন্ধকার
পাঠকের মতামত